রবিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২১, ০৩:২৭ পূর্বাহ্ন
লামিয়া মোহসীন :: ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, হায়দ্রাবাদে জহওরলাল নেহরু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনটিইউ) সুবিশাল অডিটরিয়াম যখন আলোড়িত হচ্ছিল একশত সম্মিলিত কণ্ঠ গাওয়া সেই চিরচেনা মধুর সুরে, হলফ করে বলতে পারি, মনে হচ্ছিল যেন জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলোর মধ্যে একটি অতিবাহিত করছি।
এমন অনেক ছোট ছোট, কিন্তু অসম্ভব ভালোলাগার মুহূর্ত আমার ভারত সফরকে করে তুলেছে স্মরণীয়, যা স্মৃতির মণি কোঠায় থাকবে চির-অম্লান।
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার ঐতিহাসিক ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্ব আরও সুদৃঢ় করতে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ইচ্ছায় শুরু হয় ‘বাংলাদেশ ইয়ুথ ডেলিগেশন টু ইন্ডিয়া-২০১৯’।
মূলত আচার-কৃষ্টি ও সংস্কৃতির আদান-প্রদানকে লক্ষ্য রেখে ২০১২ সাল থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন অঙ্গনের ১০০ জন তরুণ-তরুণীকে নিয়ে ভারত সফরে নিয়ে যায় হাইকমিশন।
এ বছর ৩ হাজার আবেদনকারীর মধ্যে থেকে ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে ১০০ জনকে বাছাই করে সপ্তমবারের মতো ইন্ডিয়ান হাইকমিশন, ঢাকা আয়োজন করে এই প্রোগ্রামটির।
এবারের প্রোগ্রাম সাজানো হয়েছিল দিল্লি, আগ্রা ও হায়দারাবাদের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানগুলোকে কেন্দ্র করে। ১০০ জনের বিশাল টিমের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাসের প্রথম রাজনৈতিক সচিব নবণীতা চক্রবর্তী এবং ভারতীয় হাইকমিশনের মিডিয়া ও কালচার সমন্বয়ক কল্যাণ কান্তি দাশ।
গত ২৮ মার্চ নয়া দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চল, বিভিন্ন পেশার ৪০ জন নারী ও ৬০ জন পুরুষের বৈচিত্র্যময় একটি দল, যাদের মধ্যে কেউ ছিলেন শিক্ষক, চিকিৎসক, উদ্যোক্তা, প্রকৌশলী; তেমনি কেউ বা সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সঙ্গীতশিল্পী, ক্রীড়াবিদ, মডেল, রেডিও জকি ও সমাজকর্মী।
এর আগের দিন ২৭ মার্চ বারিধারায় ভারতীয় হাইকমিশনে এক আড়ম্বরপূর্ণ ‘ফ্ল্যাগিং অফ’ (সংবর্ধনা) অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ১০০ জন সফর সঙ্গীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আসে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাশ।
বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ওয়ানডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ও সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা।
দিল্লি ভ্রমণের প্রথম দিন আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের পার্লামেন্ট ভবনে যেখানে প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টা সময় কাটাই আমরা। কড়া নিরাপত্তা এবং প্রোটোকলের মধ্য দিয়ে যখন আমাদের একে একে লোকসভা, রাজ্যসভার ঐতিহাসিক কক্ষগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন নিজেকে বেশ ভিআইপি মনে হচ্ছিল!
ব্রিটিশ আমলে তৈরি উঁচু সিলিং, দেয়ালে দেয়ালে গান্ধীজী, পণ্ডিত নেহরু, নেতাজী সুভাষচন্দ্রসহ বিশ্বনন্দিত ভারতীয় নেতা/প্রাক্তন সরকার প্রধানদের বিশাল অয়েল পেন্টিং, পুরনো কাঠের আসবাবপত্র- সব মিলিয়ে যেন ইতিহাসের পাতা থেকে খসে পড়া একটি চিত্র। পার্লামেন্ট ট্যুর শেষে আমাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন ভারতের রাজ্য সভার সংসদ সদস্য এবং ইলেক্ট্রনিক্স অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী এসএস আহলুওয়ালিয়া।
উত্তর ভারতে অবস্থিত পাঞ্জাবের অধিবাসী হয়েও অত্যন্ত স্পষ্ট এবং চমৎকার বাংলায় আমাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা রাখেন তিনি। বলেন, ‘ভারতের মতো বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি তরুণ। তাই উন্নয়নের পথে অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দেবে এই তরুণেরাই’।
উনি আরও বলেন, তারুণ্যের উদ্যম, শক্তি ও মনোবলের ওপর আস্থাশীল হতে হবে আমাদের সবার, কারণ আজকের তরুণদের ওপরেই ভবিষ্যতের পৃথিবী গড়ার দায়িত্ব। মধ্যাহ্ন ভোজের পর আমাদের একে একে নিয়ে যাওয়া হয় ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল সেন্টার ফর আর্ট, ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল ও ইন্ডিয়া গেট। ১৯৬২ সালের ইন্দো-চীনযুদ্ধ, ১৯৪৭, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালে ইন্দো-পাক যুদ্ধ, ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধ এবং শ্রীলঙ্কায় ভারতের শান্তিবাহিনীর অভিযানে নিহত শহিদদের স্মরণে তৈরি হয় মেমোরিয়ালটি।
১৯২১ সাল থেকে প্রায় ১০ বছর ধরে নির্মিত হয় ঐতিহাসিক ইন্ডিয়াগেট যার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের ১০০ জনের গ্রুপ ছবি তোলা হয়।
সন্ধ্যাবেলা এক মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার মাধ্যমে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান ভারতীয় সঙ্গীত এবং নৃত্যশিল্পীরা।
সুরের মূর্ছনায় মোহিত করেন ডেলিগেটদের পক্ষ থেকে পারফর্ম করা লালন ও রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পীরা।
এরপরের দিন চার ঘণ্টার লম্বা সফর করে গিয়েছি আগ্রা, গন্তব্য বিশ্ববিখ্যাত তমোঘল স্থাপত্য তাজমহল। যমুনা নদীর পাড়ে অবস্থিত সাদা মার্বেলের তৈরি এই আশ্চর্যকীর্তির দেখতে গিয়ে তীব্ররোদে পুড়ে গেছিলাম সবাই, কারণ সেদিনকার তাপমাত্রা ছিল ৪২ ডিগ্রির কাছাকাছি। কিন্তু এযে তাজমহল, পৃথিবীর বুকে শাশ্বত ভালোবাসার অনন্য নিদর্শন! প্রখর রোদ হোক, কি ঝুম বৃষ্টি, তাজমহল দেখতে গিয়ে সবরকম অত্যাচার হাসিমুখে সহ্য করে নেয়া বাঞ্ছনীয়।
তাজমহল থেকে গেলাম আগ্রা ফোর্ট। সম্রাট শাহজাহান জীবনের শেষ সময়টুকু এই দুর্গে কাটান গৃহবন্দি অবস্থায়। কথিত আছে, তার কক্ষ থেকে তাজমহল দেখা যেত, আর চাঁদের আলোয় এই অপার্থিব সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে সময় কাটত তার।
এরপরের দিনগুলো যেন ঝড়ের বেগে কেটে গেছে। হায়দ্রাবাদের রামোজি ফিল্ম সিটিতে বলিউডে সিনেমার দর্শকনন্দিত সেট, ঐতিহাসিক শালার জং জাদুঘরে সংরক্ষিত প্রাচীন দ্রষ্টব্য, গোলকন্দা ফোর্টের ইতিহাসের ওপর নির্মিত চমকপ্রদ লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো ইত্যাদি দেখতে দেখতে সময় কীভাবে কেটে গেছে টেরই পাইনি। হায়দ্রাবাদের জহওরলাল নেহরু প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নাচ-গান আর বাদ্য-বাজনার তালে শিক্ষার্থীরা বরণ করে নেয় আমাদের, এবং এই আতিথেয়তা কখনোই ভুলবার নয়।
সংস্কৃত ভাষায় একটি উক্তি আছে, ‘অতিথি দেব ভব’, অর্থাৎ অতিথি যেন দেবতারই স্বরূপ। একজন বাংলাদেশি ডেলিগেট হিসেবে যে ভালোবাসা এই ৬ দিনে পেয়েছি, নিঃসন্দেহে এর কোনো তুলনা হয় না। অনেক ধন্যবাদ বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনকে যারা প্রতি বছর একশ তরুণকে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেন। জ্ঞান আহরণ ছাড়াও এই ট্যুর থেকে আমার প্রাপ্তি ৯৯ জন নতুন বন্ধু, এবং এক ঝুলি অভিজ্ঞতা।
জয়তু তারুণ্য! জয়তু ভারত-বাংলাদেশ ভ্রাতৃত্ব!
লেখিকা পরিচিতি লামিয়া মোহসীন, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পড়াশোনার পাশাপাশি লেখালেখি, গবেষণা ও দেশি/বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। ‘থিংক টুঁওয়াইস, অ্যাক্ট ওয়াইস’ নামক একটি যুব- নেতৃত্বাধীন সংগঠনে গবেষণা পরিচালক হিসেবে নিয়োজিত আছেন তিনি।
ভ্রমণ করার সুযোগ হয়েছে নেপাল, ভুটান, মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশ। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে এসেছেন ভারতে অনুষ্ঠিত ‘ইয়ুথ ডেলিগেশন টু ইন্ডিয়া ২০১৯’ এ।